ডিপ্রেসন কি? ডিপ্রেশন কেনো আসে? ডিপ্রেশন থেকে বাঁচার উপায়!

ডিপ্রেসন কি? ডিপ্রেশন কেনো আসে? ডিপ্রেশন থেকে বাঁচার উপায়! 

ডিপ্রেসন কি? ডিপ্রেশন কেনো আসে? ডিপ্রেশন থেকে বাঁচার উপায়!
Depression 

  • ডিপ্রেসন কি?

 'সম্ভব না' আর 'সম্ভাবনা' এর মাঝে শুধু একটা আ-কার এর পার্থক্য... এইটুকু ভেবে তুমি যখন উচ্ছ্বসিত হচ্ছো... ঠিক তখনই তুমি দেখছো না, 'সম্ভব না' এর মাঝে একটা দূরত্ব আছে... ঐ দূরত্বটা যদি ওপাশের মানুষটা কমাতে না চায়, তাহলে শেষমেশ তোমাকেই কষ্ট পেতে হবে... আর এই কষ্টটাই ডিপ্রেসন। তুমি সব বুঝবে-জানবে কিন্তু এই ডিপ্রেসন থেকে বের হতে পারবে না, এটাও এক প্রকার ডিপ্রেসন। তুমি আড়ালে কষ্ট পেতে থাকবে এবং অন্যদের সামনে সুখে থাকার অভিনয় করতে থাকবে, এটাও ডিপ্রেসন।


‘আমার ধারণা, বেশিরভাগ মানুষের ডিপ্রেসনের কারণ আসলে সে নিজেই... নিজের বোকামি... নিজের অতিরিক্ত চাওয়া!


শেষবার আমি যে মানুষটার কাছ থেকে তীব্র রকমের কষ্ট পেয়েছি, শুরুর দিকে আমি তাকেই দোষ দিতাম। মাথা ঠান্ডা করে ভেবে দেখলাম, আসলে সেই মানুষটার কোন দোষ নেই। দোষটা আমার, আমার নিজেরই!!


কেন...?? কারণ আমি আমার LIMITATION বুঝতে পারিনি। আমি আমার সীমা অতিক্রম করে ফেলেছিলাম। সম্ভব না - জেনেও আমি মিথ্যে একটা আশা দেখিয়ে নিজেই নিজেকে ঠকিয়েছিলাম :( । আমাকে কেউ ঠকায় নি!


ধরো, তোমার কাছে ২০ টাকা আছে, তুমি তখন একটা কাপ আইসক্রিম খাওয়ার আশা করতে পারো। কিন্তু তোমার কাছে যখন ২ টাকা আছে, তখন তুমি কাপ আইসক্রিমের আশা করলে তোমাকে ভীষণ কষ্ট পেতে হবে। কারণ ঐ ২ টাকা তোমার লিমিট, এর বাইরে তুমি চাইলেও যেতে পারবে না। আর এর বাইরে যাওয়ার আশা করলেই তোমাকে বেশি পরিমাণে হতাশ হতে হবে!


একটা মানুষ কে তুমি তীব্রভাবে ভালোবাসো... কিন্তু সেই মানুষটা তোমাকে ভালোবাসে না..... তোমাদের মাঝে অনেক দূরত্ব। কিন্তু ঐ যে, তুমি তাকে তীব্রভাবে ভালোবাসো বলে তোমার চোখের সামনে একটা কাল্পনিক দূরবীন থাকে... মানুষটা সত্যিই অনেক দূরে। কিন্তু ঐ কাল্পনিক দূরবীনের জন্য তুমি ভাবো, মানুষটা আসলে তোমার খুব কাছে... কিন্তু মানুষটা অমনটা ভাবে না!!


মানুষটার একটা সামান্য 'কেমন আছো?' কে তুমি বিশাল কিছু বানিয়ে তোমার আশা-আকাঙ্ক্ষার জায়গাটুকু অনেক উঁচুতে নিয়ে যাও। তারপর একদিন ঐ উচ্চতা থেকে যখন নিচে পড়ে যাও, তখন বুকের ভেতর আহত কিছু গল্প লেখা থাকে... এই গল্পের লেখক তুমি নিজেই!!


মানুষটার কাছে তুমি আসলেই অনেক দূরের কেউ... তোমার আশা দিয়ে, তোমার চাওয়া দিয়ে, তোমার ভাবনা দিয়ে এই পৃথিবী চলে না। তোমার আর মানুষটার মাঝে যে দৃশ্যমান বিশাল দেয়ালটা আছে, সেটা তুমি দেখেও না দেখার ভান করলে দিন শেষে তুমিই কষ্ট পাবে.. আর কেউ না!!


দৌড়ে পালাতে থাকা খরগোশের চারপাশ থেকে যখন দেখলো আর লুকোনোর কোন জায়গা নেই, তখন সে চোখ বুজে ফেলেছিলো। সে ভেবেছিলো, যেহেতু সে এখন কাউকে দেখতে পাচ্ছে না, নিশ্চয়ই অন্য কেউও তাকে দেখতে পাচ্ছে না! ভুলটা কিন্তু একই রকম!!


চিন্তা করে দেখো, যাকে তুমি চাচ্ছো, সে তোমাকে চাচ্ছে না...! কি করা উচিত তোমার ?? সরে আসা উচিত... :) কিন্তু তুমি পারছো না সরে আসতে। সাময়িক ভালোলাগার জন্য তুমি দীর্ঘমেয়াদী কষ্টের মাঝে নিজেকে ফেলে দিচ্ছো!


'সম্ভব না' আর 'সম্ভাবনা' এর মাঝে শুধু একটা আ-কার এর পার্থক্য... এইটুকু ভেবে তুমি যখন উচ্ছ্বসিত হচ্ছো ... ঠিক তখনই তুমি দেখছো না, 'সম্ভব না' এর মাঝে একটা দূরত্ব আছে... ঐ দূরত্বটা যদি ওপাশের মানুষটা কমাতে না চায়, তাহলে শেষমেশ তোমাকেই কষ্ট পেতে হবে... হ্যাঁ, শুধু তোমাকেই!


ভুল জায়গায় আটকে থাকা পাপ.. ভুল মানুষের জন্য অপেক্ষা করা মহাপাপ। বোকা মানুষ গুলোই জেনে শুনে ভুল জায়গায় ভুল মানুষের জন্য আটকে থাকে! 


দু ফোঁটা চোখের জল ফেলে সরে আসলেই কষ্ট কম হয় - তবুও আটকে থাকে। তারপর একদিন সেই দু ফোঁটা চোখের জল চার ফোঁটা, আট ফোঁটা হয়ে বাড়তে বাড়তে এক বিশাল সমুদ্র হয়ে যায়... তখন আর ফেরত আসা যায় না... তখন আর ফেরত আসা হয় না!


তাই এই সমস্ত কিছু ভুলে যাও। ডিপ্রেসনের কারণটা জেনে নিজেকে বাস্তবতায় পরিনত করো। যে জিনিষটা তুমার না, সেটা নিজের ভাববার কোন মানে হয় না। যতই ভাববে ততই তোমার চোখ ভিজে থাকবে, চোখ থেকে গাল এবং গাল থেকে একসময় হৃদয়ে... এমন কি হৃদয়ের গহিনে যে ভালবাসাটা অন্য কারো জন্য অপেক্ষারত সেটিও ভিজে চুপসে যাবে। তুমার জন্য অপেক্ষারত মানুষটির ক্ষতি তুমি করতে পারো না। তাই বেরিয়ে এসো, চলে এসো, ফিরে এসো... শুধু মাত্র তুমার জন্য, শুধু মাত্র অপেক্ষারত মানুষটির জন্য! দেখবে দিন শেষে তুমিই সুখী।


  • জেনে নিন ডিপ্রেশন বা বিষণ্ণতার প্রকার:–  

Major Depression ( মেজর ডিপ্রেশন )= ইহা দুই সপ্তাহ থেকে কয়েক মাস অব্যাহত থাকে এবং চিকিৎসা না করালে আবার হওয়ার আশঙ্কা থাকে এবং পরবর্তীতে বিপোলার ডিসঅর্ডার হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায় — প্রতিটি পুনরাক্রমণ অনেক দিন পর্যন্ত অব্যাহত থাকার প্রবণতা দেখা দেয়। তখন রোগীকে মানসিকভাবে দুর্বল করে সাথে অন্যান্য অসুখ বিসুখ দেখা দিয়ে থাকে ।

তখন ঃ- মানসিক ভাবে যে কোন কিছু তে অনাগ্রহ এবং আনন্দ ফুর্তি কমে যায় । বিশেষ করে কার ও বেলায় সাময়িক যৌন উত্তানের মারাত্তবক অবনতি ঘটে । ওজন হ্রাস পাওয়া- ঘুমের অসুবিধা বিশেষ করে রাতে ঘুম না হওয়ায় দিনে ঘুমের আগ্রহ থাকে — অকারনে বিরক্তা বেড়ে যাওয়া – ক্লান্ত এবং বিনা কারনে দুর্বলতা -নিজকে অপরাধী এবং অর্থহীন মনে হওয়া — কোন কিছুর সিদ্বান্ত নিতে অসুবিধা মনে করা – এ ধরণের সমস্যা দীর্ঘদিন ভোগতে থাকলে শেষ পর্যন্ত কেউ কেউ আত্ম -হত্যার কথা ভাবে ।

  • ডিপ্রেসন কাদের হয়?

ডিপ্রেসন কি? ডিপ্রেশন কেনো আসে? ডিপ্রেশন থেকে বাঁচার উপায়!
Depression 
পরিসংখ্যানে দেখা গেছে যে ডিপ্রেসন বা মানসিক অবসাদ ভোগেন এমন রোগীর সংখ্যা এমন কিছু কম নয়, এবং বেশীর ভাগ রোগীরই চিকিৎসা করা হয় না  কারন তারা বুঝতে পারে না যে তাদের ডিপ্রেসন হয়েছে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে যে সারা বিশ্বে যে কোনো সময় প্রায় দশ কোটি মানুষের ডিপ্রেসন হয়, কিন্তু তার মধ্যে মাত্র এক কোটি রোগি ডাক্তারের কাছে যায় চিকিৎসা করাতে।মানসিক অবসাদের এই অবস্থা নারী পুরুষের মধ্যে প্রায় সমান সংখ্যায় হয়, যদিও পুরুষদের মধ্যে ডিপ্রেসন বেশী হয় বৃদ্ধ অবস্থায়। যেকোনো বয়সে এই মানসিক অবসাদ হতে পারে, এমনকি দশ বছরের কম শিশুদের মধ্যেও। শিশু বা বয়ঃসন্ধিক্ষনে ডিপ্রেসনের উপসর্গগুলো অনেকটা আলাদা হয়।

  • ডিপ্রেসন বা অবসাদ কেন হয়?

দেহের কোনো কারনের জন্য বিষন্নতা হতে পারে কি?
অনেক পরিক্ষায় বা গবেষনায় পাওয়া গেছে যে শারীরিক কিছু পরিবর্তনের জন্য মনের বিষন্নতা আসতে পারে। যেমন—

  • ১) ব্রেনের বা মস্তিষ্কের নানা নিউরোট্রান্সমিটারের পরিবর্তনের জন্য অবসাদ হতে পারে।
নানা নিউরোট্রান্সমিটারের মধ্যে দুটি বিশেষ উল্লেখ যোগ্য, যেমন নর এপিনেফ্রিন(norepinephrine) ও সেরোটোনিন(serotonin)।নিউরোট্রান্সমিটার হল এক রকমের কেমিক্যাল যেটা সাধারনতঃ নার্ভকোষে সব সময় তৈরী হয়ে চলেছে।যখন নার্ভ এর উত্তেজনা হয় তখন সেটা বাইরে বেরিয়ে এসে অন্য নার্ভকে উত্তেজিত করে, এই ভাবে এক নার্ভ থেকে অন্য নার্ভে যোগাযোগের জন্য আমরা সব অনুভূতি পাই।  এই নর এপিনেফ্রিন( norepinephrine) এর উপর প্রভাব ফেলে ভেনলাফাক্সিন(Venlafaxine) নামক ঔষধ যেটা ডিপ্রেসনের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। সেই জন্য মনে করা হয় নর-এপিনেফ্রিন যে নার্ভকোষের উপর কাজ করে তার বেশী ক্রিয়ার জন্য ডিপ্রেসন হয়।

নার্ভে  সেরোটোনিন(serotonin) এর কম হওয়ার জন্য হয়ত ডিপ্রেসন হয়।

কারন দেখাগেছে ফ্লুওক্সেটিন(Fluoxetine) নামক ডিপ্রেসনের ঔষধ ব্রেনে সেরোটোনিনের পরিমান বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য  মনের অবস্থার উন্নতি হয়েছে। তাই মনে করা হয়, সেরোটোনিন এর পরিমান কমে যাওয়ার জন্য হয়ত এই রোগটা হয়।শেষ কয়েক দশকে আরো কয়েক রকমের সেরোটোনিনের সন্ধান পাওয়া গেছে, যেগুলো আরো নানা ভাবে মনের উপর প্রভাব ফেলে।

ডোপামিন(Dopamine) আরেক রকমের নিউরোট্রান্সমিটার যেটা কম হওয়ার জন্য হয়ত ডিপ্রেসন হয়। কারন দেখা গেছে, টাইরোসিন (tyrosine) নামক অ্যামিনো অ্যাসিড, অ্যাম্ফিটামিন(amphetamine), বা বিউপ্রোপিওন(Bupropion),ইত্যাদি ব্রনের মধ্যে ডোপামিনের পরিমান বাড়িয়ে দেয়, তার জন্য এই ঔষঢগুলোকে ডিপ্রাসনের চিকিৎসায় ব্যবহার করা যেতে পারে। আবার আমরা জানি যে পারকিনসন স্নায়ু রোগের(Parkinson’s disease)কারন হল ব্রেনের কিছু স্থানে বা সেন্টারে ডোপামিন কম হওয়া। সেই জন্য অনেক পারকিনসন রোগীর ডিপ্রেসন হয়।উপরের যে নিউরোট্রান্সমিটার গুলো বলা হল তাছাড়াও আরো নিউরোট্রান্সমিটার আছে যেমন, অ্যসিটাইলকোলিন(Acetylcholine) , গাবা( GABA, Gama Amino Butyric Acid), ইত্যাদি ডিপ্রেসনের কারন হতে পারে।

  • ২) হরমোনের কম বেশি হওয়ার জন্যও ডিপ্রেসন হতে পারে।  
যেমন থাইরয়েড (thyroid hormone ) হরমোন ও গ্রোথ (Growth hormone ) হরমোন কম হলে ডিপ্রেসন হয়। এছাড়া আরো নানা হরমোন আছে যার পরিমানের কম বেশি হওয়ার জন্য মনে উপর প্রভাব ফেলতে পারে,সেগুলো আর বলা হল না।হরমোন ও নিউরোট্রান্সমিটার কিভাবে কাজ করে,এবং কি ভাবে ডিপ্রেসন হয় এটা খুব জটিল, আর উপরের কারন গুলো খুব সরল ভাবে বর্ননা করা হল।

  • ৩) ব্রেনের আকৃতির পরিবর্তনঃ
ক্যাট স্ক্যান (CAT Scan) বা এম আর আই(MRI) করে ব্রেনে নানা পরিবর্তন পাওয়া গেছে, যেমন ভেন্ট্রিকল বড় হয়েছে, ব্রেনের কিছু জায়গায় নার্ভ শুকিয়ে গেছে, ইত্যাদি সেগুলো আবার সব রোগির ক্ষেত্রে পাওয়া যায় নি।আবার পেট স্ক্যান(PET scan) করে পাওয়া গেছে যে যাদের ডিপ্রেসন হয়েছে তাদের ব্রেনের কিছু কিছু জায়গায় রক্তের চলাচল কমে গেছে। যখন ডিপ্রেসনের থেকে সেরে উঠেছে তখন আবার রক্ত চলাচল স্বাভাবিক হয়ে গেছে। এই সব পরিবর্তন কিছু কিছু ডিপ্রেসনের রোগির ব্রেনে পাওয়া গেছে, সবার ডিপ্রেসন রোগির মধ্যে পাওয়া যায় নি।

  • ডিপ্রেসন বা বিষন্নতা রোগ কি বংশগত?

ডিপ্রেসন কি? ডিপ্রেশন কেনো আসে? ডিপ্রেশন থেকে বাঁচার উপায়!




ফ্যামিলি স্টাডি, যেসব শিশুদের দত্তক নেওয়া হয়েছে তাদেরকে, এবং যমজ ছেলে মেয়েদের বেশ কয়েক বছর লক্ষ্য করার পর জানাগেছে যে, আমাদের এই মুডের (Mood) এর কারন অনেকটা বংশগত। যদি মা বা বাবার কোন একজনের ডিপ্রেসন বা ম্যানিয়া থাকে তাহলে তাদের সন্তানদেরও  ওই ডিপ্রেসন বা ম্যানিয়া হওয়ার সম্ভাবনা ১০ থেকে ২৫ শতাংশ। আর যদি পিতা মাতার দুজনেরই মুড প্রবলেম আছে তাহলে সন্তানদের হওয়ার সম্ভাবনা দ্বিগুন হয়ে যায়।যমজ( যারা একদম একরকম) এক জনের যদি ডিপ্রেসন বা ম্যানিয়া থাকে তবে অন্য যমজ সন্তানের হওয়ার সম্ভাবনা ৭০ থেকে ৯০ শতাংশ। যমজ (অথচ একদম একরকম নয়) তাদের একজনের যদি হয় তবে অন্য জনের হওয়ার সম্ভাবনা ১৬ থেকে ৩৫ শতাংশ। সুতরাং এর থেকে বেশ বোঝা যাচ্ছে যে বংশগত কারন একটা প্রধান কারন।


  • ডিপ্রেসন বা বিষন্নতা বা মানসিক অবসাদ

ডিপ্রেসন বা মানসিক অবসাদের কথা অমরা আজকাল প্রায়ই লোকের মুখে শুনে থাকি। অনেকেই হয়ত কম বেশী এই অবস্থার মধ্যে দিয়ে গেছেন। কেউ কেউ প্রায় সময়ই বলে থাকেন মন ভাল নেই, সেটা কি ডিপ্রেসন না অন্য কিছু, যেমন মনে আনন্দ নেই, সেটা যে কারনেই হোক না কেন।উদাহরন স্বরূপ বলা যেতে পারে কেউ কোনো কাজে অসফল হয়েছে তার জন্য মন খারাপ, বা কেউ পরিক্ষায় ফেল করেছে তার জন্য মন খারাপ, বা কেউ ভালবাসায় ব্যর্থ হয়েছে তার জন্য মনে আঘাত লেগেছে। এই অবস্থাগুলোকে কি ডিপ্রেসন বলা যাবে? হয়ত কিছু কিছু ক্ষেত্রে বলা যাবে যদি দৈনন্দিন কাজ কর্ম ব্যহত হয়, আর মনে বিশেষ কষ্ট হয় তাহলে। এই বিষন্ন অবস্থা অনেক সময় ভুক্তভোগী নাও বুঝতে পারে, যদিও তার খুব অসুবিধা হয়।

  • বিষন্নতা বা মানসিক অবসাদের কি কি উপসর্গ?

ডিপ্রেসনের প্রধান উপসর্গ হল, ভাল না লাগা, বা ইংরাজিতে যাকে বলে লো মুড(Low mood)। কিন্তু কারও কারও ডিপ্রেসন না হয়ে খিটখিটে বা রাগের ভাব বেশী হতে পারে। আরো উপসর্গগুলো নিচে দেওয়া হলঃ

  • ১) বেশীরভাগ সময় মন ভাল না লাগা, বা কারও কারও সব সময় রাগ বা খিটখিটে মেজাজ।

  • ২) ঘুমের অসুবিধা, যেমন, প্রথম রাত্রিতে ঘুম ঠিক এসে যায়, কিন্তু মাঝ রাত্রিতে বা খুব সকালে ঘুম ভেঙ্গে যায়, তারপর যার ঘুম আসে না। আবার ঘুমটা ভাঙ্গা ভাঙ্গাও হতে পারে।

  • ৩) খেতে ইচ্ছা না করা, তার জন্য দেহের ওজন কমে যেতে পারে। আবার কেউ কেউ ম্ন খারাপের জন্য অনেক বেশী খেয়ে বেশ মোটা হয়ে যেতে পারে। তারা আবার বেশি ঘুমায়ও।

  • ৪)আগে যা যা করতে ভাল লাগত তা আর ভাল লাগে না, যেমন গান শোনা, বই পড়া, বা সিনেমায় যাওয়া, বা বেড়াতে যাওয়া ইত্যাদি।এমনকি যৌনকাঙ্খাও কমে যায়।

  • ৫)নিজেকে গুটিয়ে ফেলে, বন্ধু বান্ধব, বা আত্মীয় স্বজন কারো সাথে মেলামেশা না করা।

  • ৬) কাজে না যাওয়া, বা পড়াশোনা বন্ধ করে দেয়।

  • ৭) অনেকে বলেন স্মৃতি শক্তি কমে গেছে, কিছু মনে থাকে না, ঠিক মত মনোযোগ দিয়ে কাজ করতে পারেন না। তার জন্য কাজে ভুল হতে পারে। কাজ সম্পূর্ন করতে অনেক বেশি সময় নিতে পারে।

  • ৮) কেউ কেউ বলেন, যখন ডিপ্রেসনের মাত্রা বেশী হয়, যে বেঁচে থেকে লাভ নেই। মরে যাওয়াই ভাল। এই সময় অনেকে আত্মহত্যা করে ফেলতে পারেন।

  • ৯) আমাদের দেশে ডিপ্রেসন হলে অনেকে বলেন, গা, হাত পা ব্যথা করছে, মাথা ব্যথা সব সময়। যাদের ডিপ্রেসনের সাথে টেনশন থাকে তারা বলেন, বুক ধড়ফড় করছে, গা, হাত পা ঝিন ঝিন করছে, যেন সাংঘাতিক কোনো দুরর্ঘটনা ঘটে যাবে।এক মুহূর্তের জন্য শান্ত থাকতে পারেন না। ভারতবর্ষে বা তার আশপাশের দেশ গুলোতে অবসাদের রোগীরা আরো নানা রকম শারীরিক উপসর্গ যেমন, হজমে গন্ডগোল, মাসিকে গন্ডগোল বা মাসিক বন্ধ হয়ে যাওয়া, কোষ্ঠকাঠিন্ন, ইত্যাদিও হয়। তারজন্য রোগি অনেক সময় চিকিৎসার জন্য জেনারেল ডাক্তারের কাছে যায়।

  • ১০) এমনও দেখা গেছে অবসাদ অবস্থা যখন খুব বেশি হয় তখন রোগী কানে নানা কথা শুনতে পারে(হ্যালুসিনেসন,) যেমন কেউ যেন বলছে, ‘ তোমার বেঁচে থেকে লাভ নেই,এখনই মরে যাও, তুমি অনেক পাপকাজ করেছ, ইত্যাদি’। এই সময় রোগী ওই কথাগুলোকে সত্যি মনে করে আর তাতে আত্মহত্যা করার প্রবনতা অনেক বেশি হয়।


  • ডিপ্রেসন বা অবসাদ কি ভাবে প্রভাব ফেলতে পারে?

ডিপ্রেসন কি? ডিপ্রেশন কেনো আসে? ডিপ্রেশন থেকে বাঁচার উপায়!

কারও মানসিক অবসাদ হলে তার জীবনে বেশ গভীর ভাবে প্রভাব ফেলতে পারে, যেমন—

  • ১) কাজকর্মে অসুবিধা, নানা ভুল করতে পারে, কাজে মন না লাগার জন্য কাজে দেরী হওয়া, কাজে না যাওয়া, ইত্যাদি। কাজ না করার জন্য পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ হয়ে যায়।

  • ২) পরিবারের সঙ্গে মানিয়ে চলতে পারে না। ছেলে মেয়েদের দেখাশোনা ইত্যাদি ঠিকমত করতে পারে না।

  • ৩) বন্ধু বান্ধব বা আত্মীয় স্বজনের থেকে দূরে সরে যায়।

  • ৫) যদি উঠতি বয়সের সময় এই অবসাদ হয় তখন তারা পড়াশোনায় মন দিতে পারে না, প্রায় রাগ ভাব আব ছটফটে ভাব হয় বা একদম নিস্তেজ ভাব হয়ে যায়। এতে পড়াশোনায় পিছিয়ে পড়তে পারে, সেটা আর কখনো মেকাপ করতে পারে না, যদি না সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসা করা হয়।

  • ৬) কেউ কেউ আবার নানা ড্রাগ নেওয়া শুরু করতে পারে, তখন ডিপ্রেসনের মাত্রা আরো বাড়তে পারে। অনেকে ভাবেন অ্যালকোহল খেলে হয়ত মনের অবসাদের ভাবটা কেটে যাবে। কিন্তু তাতে ডিপ্রেসনের মাত্রা আরো বেশী বেড়ে যায়। এমনকি আত্মহত্যা করার প্রবনতা বেড়ে যায়।সুতরাং দেখা যাচ্ছে মানসিক অবসাদের জন্য রোগীর জীবনে সব ক্ষেত্রেই প্রভাব ফেলে।

  • ডিপ্রাসন কি সামাজিক কোনো কারনে হয়?

জীবনের ও পারিপার্শিক নানা কারনে মানসিক চাপের জন্য এই বিষন্নতা ভাব আসতে পারে। কেউ কেউ মনে করেন জীবনের নানা ঘাতপ্রতিঘাত ও মানসিক চাপের জন্যই ডিপ্রেসন হয়। আর কেউ কেউ মনে করেন এই মানসিক চাপ ডিপ্রেসন করার জন্য এমনকিছু প্রভাব ফেলে না।

লক্ষ্য করা গেছে যে কোনো শিশু যদি এগারো বছর বয়সের আগে তার মা বাবার একজনকে হারায় তবে তাদের বড় হয়ে বিষন্নতা বা অবসাদ অবস্থা হওয়ার সম্ভাবনা খুব বেশি। এটা প্রায়ই দেখা যায় বিশেষ কোনো ক্ষতি হলে বা বিশষ কিছু হারালে ডিপ্রেসনের আরম্ভ হয়। যেমন নিকট কোনো আত্মীয় স্বজন হারালে বা মৃত্যু হলে, হঠাৎ  বেশী টাকার কোনো লোকসান বা হারালে, বা চাকরি হারালে বা অবসর নিলে(বিশেষ করে যদি পরিবার স্বচ্ছল অবস্থায় না হয়), বিবাহ বিচ্ছেদ বা ভালবাসায় বিচ্ছেদ হলে, এমনকিপরীক্ষায় অসফল হলে, ইত্যাদি। কোন কারনে ডিপ্রেসন হবে তা অনেকটা নির্ভর করে বিভিন্ন মানুষের বিভিন্ন কারনের উপর বিশেষ গুরুত্ত দেওয়ার জন্য।



  • বিশেষ চিন্তার পরিবর্তনে কি ডিপ্রেসনের কারন হতে পারে?

ডিপ্রেসন কি? ডিপ্রেশন কেনো আসে? ডিপ্রেশন থেকে বাঁচার উপায়!

বিখ্যাত সাইকোলজিস্ট অ্যারন বেক(Aaron Beck)এর মতে, ডিপ্রেসনে ভোগেন সেই সব রোগিদের চিন্তার কিছু পরিবর্তন হয় যেমনঃ

  • তারা নিজেদের সম্বন্ধে নেতিবাচক ধারনা থাকে যেমন ভাবে তাদের দ্বারা কিছু হবে না,তারা অপদার্থ ইত্যাদি,

  • পারিপার্শিক অবস্থা সম্বন্ধে ভাবে যে সেটা ভীষন এবং অনেককিছু আশা করে তার কাছ থেকে

  • ভবিষ্যত সম্বন্ধে ভাবে সব সময় তাদের হার হবে আর তাদের ভুগতে হবে। সেই মনে করা হয় যদি এই ভুল ধারনা গুলো থেরাপি করে ঠিক করা যায় তবে ডিপ্রেসনেরও উপশম হবে।

  • ডিপ্রেসন কি একটা অসহায় অবস্থা যেটা মানুষ জীবন ধারনের মধ্যে শেখে?

মনে করা হয় যদি কেউ পরের পর খারাপ অবস্থার বা মানসিক চাপের মধ্যে দিয়ে যেতে থাকে তবে তাদের মধ্যে এই অবস্থার সৃস্টি হতে পারে। তখন সে ভাবে তার আর এই খারাপ অবস্থার মধ্যেদিয়ে বেরোনোর উপায় নেই, হতাশ হয়ে যায়, সব আত্মবিশ্বাসও হারিয়ে ফেলে।সেই অবস্থাকে ডিপ্রেসন বলা হয়। সুতরাং একে বলা যেতে পারে বার বার আঘাতের জন্য এক অসহায় অবস্থা।

মনে রাখা দরকার কোনো একটা বিশেষ কারনে ডিপ্রেসন হয় না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অনেকগুলো কারন এক সঙ্গে কাজ করে। আবার আর এক রকমের বিষন্নতা আছে যেটার কোন কারন নেই, সেটাকে বলা হয় মেলানকোলিক ডিপ্রেসন(Melancholic depression). এতে রোগির মনের মধ্যে একদম আনন্দ থাকে না,অনেক সকালে ঘুম ভেঙ্গে যায়, খাওয়া দাওয়া কম করার জন্য বেশ রোগা হয়ে যায়, আর মনের মধ্যে খুব অনুশোচনা ভাব থাকে(এমনকি খুব ছোট কিছুর জন্যও)। এদের কেউ কেউ আত্মহত্যার করার কথাও বলেন।এদের কোনো কোনো সময় নানা হরমোনের গন্ডগোল থাকতে পারে।

  • ডিপ্রেসনের সাথে আর কি কোনো উপসর্গ থাকতে পারে?

ডিপ্রেসনের সঙ্গে বেশির ভাগ সময়েই আরো নানা উপসর্গ থাকে, যেমন—

  • কারো কারো উদ্দিগ্নভাব থাকে, যেমন বলে এক জায়গায় স্থির হয়ে থাকতে পারে না। নানা শারীরিক উপসর্গ থাকে যেমন, বুক ধড় ফড় করা, মাথা ঝিম ঝিম করা, অনেকটা প্যানিক অ্যাটাকের মত।

  • কারো কারো নানা রকম বাতিক থাকে যেমন, ধোয়া ধুয়ি বাতিক, গোনা বাতিক, রোগের বাতিক, নিয়মের বাতিক ইত্যাদি।

  • এর সঙ্গে কেউ কেউ কানে নানা কথা শুনতে (হ্যালুসিনেসন) পান, যেন কেঊ তাদের নানা দোষারোপ করছে, বা তাদের সমালোচনা করছে ইত্যাদি হতে পারে।

  • কেউ কেউ নানা ড্রাগ ব্যাবহার করতে পারে, তার জন্য এই ডিপ্রেসন হতে পারে।

  • কারো যদি কোনো ক্রনিক কোনো রোগ অনেকদিন ধরে থাকে, তবে তাদেরও ডিপ্রেসন বা বিষন্নতা হতে পারে।

  • ডিপ্রেসন ও আত্মহত্যা

ডিপ্রেসন কি? ডিপ্রেশন কেনো আসে? ডিপ্রেশন থেকে বাঁচার উপায়!

আত্মহত্যার একটা বিশেষ কারন হল ডিপ্রেসন বা বিষন্নতা অবস্থা। সেই জন্য ডিপ্রেসন হলেই বিশেষ করে খেয়াল রাখতে হবে এই আত্মহত্যার কথা। প্রচলিত ধারনা আছে যে আত্মহত্যার কথা জিজ্ঞাসা করলে নাকি আত্মহত্যার প্রবনতা বেড়ে যায়। এর কোনো সঠিক প্রমান পাওয়া যায় নি।

কোনো ডিপ্রেসনের রোগির আত্মহত্যার করার প্রবনতা বাড়ে যদিঃ
  • সে পুরুষ হয়, অবিবাহিত বা একা থাকেন বা পত্নিবিয়োগ হয়েছে

  • ডিপ্রেসনের মাত্রা বেশি হয়, যেমন কানে নানা কথা শুনছেন যে ‘বেচে থেক কি লাভ, মরে যাওয়াই ভাল ইত্যাদি’। বা বলছেন যে ‘আগে অনেক পাপ করেছেন, বা দুর্নিতি করেছেন তার জন্য ভুগতে হচ্ছে, বা পুলিশে ধরে নিয়ে যাবে, ইত্যাদি।

  • বলেন ভবিষ্যতে আর আশা নেই, অসহায় অবস্থা প্রকাশ করছেন সব সময়। বলছেন কেউ তাকে আর ঠিক করতে বা সাহায্য করতে পারবে না।

  • আত্মহত্যা করার আগে তাঁরা বেশ প্ল্যান করেই করেন। অনেকেই মরার আগে সুইসাইড নোট লিখে রেখে যান।

  • যারা আগে আত্মহত্যা করতে গিয়ে অসফল হয়েছেন, তারা পরের বার আরও সাংঘাতিক রকমের আত্মহত্যার চেস্টা করেন। সুতরাং এটাও ভুল ধারনা যে যারা একবার আত্মহত্যায় অসফল হয় তারা আর আত্মহত্যার চেস্টা করে না।

  • কোনো না কোনো ভাবে আগে কাউকে আত্মহত্যার কথা বলে থাকেন এই সব ডিপ্রেসনের রোগিরা।তাই সব সময় সতর্ক থাকা দরকার।

  • ডিপ্রেসনের রোগির অ্যালকোহলের নেশা থাকলে, আত্মহত্যার প্রবনতা বেড়ে যায়।

  • ডিপ্রেসন বা বিষন্নতা

ডিপ্রেশন হলো ইমোশনাল ইলনেস । এ রোগে ব্যক্তির মন-মেজাজ বা মুডের অবনতি ঘটে যাওয়া কে ডিপ্রেশন বা বিষণ্নতা বলা হয় । ইহা মানসিক রোগের আওতার একটি অসুখ । চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় যে কোন কারনে মস্তিষ্কে নিউরোট্রান্সমিটারের পরিবর্তন ঘটলেই ডিপ্রেসন বা বিষন্নতার সৃষ্টি হয় ।

সদ্য প্রমান সহকারে দেখানো হয়েছে যাহারা মিথ্যা কথা বলতে অভ্যস্থ এবং কুৎস রটনা করতে বেশ ভালবাসেন তাহারা সাধারণ অন্যান্য কারনের চাইতে ৭৫% % বেশী ডিপ্রেশন বা বিষণ্নতা য় ভোগার সম্বাভনা আছেই এবং এ ধরণের মানুষের ডিপ্রেশন এমনিতে দেখে বুজা যায়না । এ ছাড়া ও হার্টের অসুখ এবং ডায়াবেটিস জাতীয় অসুখের মাত্রায় বেশী ভুগবেন ইহা ও ১০০% নিশ্চিত ( ক্লিনিক্যালি – প্রমান ও তথ্য ২য় পর্বে দেওয়া আছে )

অন্যদিকে আরেকটি ভুলা ধারনা আছে অনেক সময় কিছু ভাল লাগেনা – চিন্তা- অশান্তি- ইত্যাদি করলেই যে ডিপ্রেশনে ভোগবেন ইহা ও ঠিক নয় যদি মানসিক ভাবে এ জাতীয় চিন্তাকে প্রশ্রয় দেওয়া না হয় তারপর ও সময় উপযোগী উপযোক্ত ব্যাবস্থা গ্রহন করলে ৯৯% রোগী ভাল হয়ে যাবেন । একটা কথা মনে রাখবেন ? ভাল জাতীয় চিন্তা বরং মস্তিষ্কের জন্য ভাল এবং নিউরোনের ট্রান্সমিটার সমূহ ( norepinephrine,serotonin,Dopamine ) কে আর বৃদ্ধি করতে সহায়তা করে ।

মানসিক অবসাদের এই অবস্থা নারী পুরুষের মধ্যে প্রায় সমান সংখ্যায় হয় ( এশিয়ান মহিলাদের বেলায় এবং পুরুষদের বেলায় বৃদ্ধ অবস্থায় একটু বেশী হয়ে থাকে ) তারপর ও যেকোনো বয়সে এই মানসিক অবসাদ হতে পারে, এমনকি দশ বছরের কম শিশুদের মধ্যেও। তবে শিশু বা বয়ঃসন্ধিক্ষনে ডিপ্রেসনের উপসর্গগুলো অনেকটা আলাদা যা সাধারণ দৃষ্টিতে বুজা খুব কঠিন এবং জঠিল ।

  • কিভাবে ডিপ্রেশন হয়ে থাকেঃ- ( বিজ্ঞান অনুসারে )

( নিউরোট্রান্সমিটার হল এক রকমের কেমিক্যাল যেটা সাধারনতঃ নার্ভকোষে সব সময় তৈরী হয়ে চলেছে।যখন নার্ভ এর উত্তেজনা হয় তখন সেটা বাইরে বেরিয়ে এসে অন্য নার্ভকে উত্তেজিত করে, এই ভাবে এক নার্ভ থেকে অন্য নার্ভে যোগাযোগের জন্য আমরা সকল অনুভূতি পেয়ে থাকি ) ব্রেনের বা মস্তিষ্কের নিউরোট্রান্সমিটারের মধ্যে দুটি বিশেষ উল্লেখ যোগ্য হরমোন , এপিনেফ্রিন(norepinephrine) ও সেরোটোনিন(serotonin) কোন কারনে এই এপিনেফ্রিন যে নার্ভকোষের উপর কাজ করে তার বেশী ক্রিয়া করে জন্য ডিপ্রেসন হয়ে থাকে ।

অন্যদিকে যে কোন কারনে নার্ভে সেরোটোনিন(serotonin) ঘাটতি দেখা দিলে ও ডিপ্রেসন হয়ে থাকে । এ ছাড়া ও আরেকটি হরমোন আছে যাকে ডোপামিন বলা হয় । এই ডোপামিন(Dopamine) নিউরোট্রান্সমিটার কম হওয়ার জন্য ও ডিপ্রেসন হয়ে থাকে । সে জন্য এই নিউরট্রান্সমিটার সমূহ সঠিক ভাবে নিয়ন্ত্রিত করতে পারলেই ডিপ্রেশন বা মানসিক অবসাদ থেকে মুক্তি পাওয়া সম্বভ । সদ্য আবিষ্কৃত আর কয়েকটি নিউরোট্রান্সমিটার আছে যেমন, অ্যসিটাইলকোলিন(Acetylcholine) , গাবা( GABA, Gama Amino Butyric Acid), ইত্যাদির ঘাটতির ফলে ডিপ্রেসন হতে পারে বলে মনে করা হয় ।

থাইরয়েড (thyroid hormone ) হরমোন ও গ্রোথ (Growth hormone ) হরমোন কম হলে ডিপ্রেসন হয়ে থাকে । অথবা ব্রেনের আকৃতির পরিবর্তন বা কার্যকলাপের যে কোন অসুবিধায় ডিপ্রেশন হতে পারে , বিশেষ করে মস্তিষ্কের নার্ভ শুঁকিয়ে গেলে ডিপ্রেশন সহ আর অনেক ধরণের মারাত্মক সমস্যার সৃষ্টি হবেই । এবং এইসব হরমোন সমূহ বৃদ্ধি বা কমতি অনেকটা নির্ভর করে শারীরিক , বংশগত , এবং পরিবেশগত কারনের উপর অথবা অন্য যে কোন অসুখের আক্রমণের উপর ।

  • চিকিৎসা ও ব্যাবস্থাপনাঃ-

৯০% বেলায় টক থ্যারাপি , এন্টি- ডিপ্রেশনাল ড্রাগস, SSRIs ( বিশেষ করে সেরোটোনিন বৃদ্ধি কারক ড্রাগস – Wellbutrin ) Electroconvulsive therapy ইলেক্ট্রোকনভালসিব থেরেপি (ECT), ম্যাগনেটিক স্টিমোলেশন (rTMS), আকুপাংচার , রীতিমত শারীরিক ব্যায়াম ( ভোরের ) , ইত্যাদি ভাল চিকিৎসকের পরামর্ষে বেশ কিছু দিন করালে ১০০% ঠিক হয়ে যায় – মেজর ডিপ্রেশনের আরও অনেক পদ্ধতির চিকিৎসা শেষ পর্বে জানতে পারবেন –


  • Persistent Depressive Disorder বা ডিসথেইমিয়াঃ-    

এটি দীর্ঘমেয়াদি ডিপ্রেশন (Long-term depression). এ ধরনের ডিপ্রেশন বেশ কয়েক বছর পর্যন্ত চলতে থাকে। কিছু কিছু মানুষ তাদের জীবনের অসহনীয় ঘটনার ফলস্বরূপ এটিতে আক্রান্ত হতে পারে। এ ধরণের অসুখে ভুগলে কখন ও বেশী ঘুম আবার ক খন ও একেবারেই হয়না । শরীরের শক্তি ক্ষয় হতে থাকে এবং মাথা ঘোরার ভাব চলে আসা – খাওয়ার রুচির পরিবর্তন ( কখন ও বেশী খাওয়া আবার কখন ও একেবারে অল্পতে পেট ভরে যাওয়া মনে হওয়া ) । যে কোন কিছু সিদ্ধান্ত নিতে অনিহা বা প্রায় সময় হতাস ভাব প্রকাশ করা ইত্যাদি ।

  • চিকিৎসাঃ– এই জাতীয় অসুখে বেশির ভাগি সাইকোথ্যারাপি , ঔষধ ইত্যাদি দীর্ঘদিন ( কম পক্ষে ৩ মাস ) ভাল চিকিৎসকের পরামর্ষে সেবন করলে ভাল হয়ে যাওয়ার কথা যদি শরীরের অন্যান্য কোন অসুখ বিশুখের সাথে সম্পর্ক যোক্ত না হয়.

  • ম্যানিক ডিপ্রেশন ( bipolar disorder )

ডিপ্রেসন কি? ডিপ্রেশন কেনো আসে? ডিপ্রেশন থেকে বাঁচার উপায়!


এ ধরণের অসুখে ডিপ্রেশন কয়েক সপ্তাহ দেখা দেওয়ার পর মনে হয় কমে গেছে কিন্তু পরবর্তীতে ম্যানিয়ায় রূপ নেয়। মুলত ইহা খুভ ঘন ঘন মানুষের মুড বা মিজাজের পরিবর্তন করে সে জন্য কেউ কেউ এমনিতেই কাঁদে আবার অনেক সময় গান গায় – এ মানসিক অবস্থা বা রোগটি যে কোনো বয়স বা সময়েই আরম্ভ হতে পারে। অন্যদিকে এই অসুখ টি জীনগত কারনে হয় বিদায় বংশগত ও হতে পারে । মোট কথায় এ রোগ টি দারুণ ভোগান্তির সৃষ্টি করে। মাঝেমধ্যে স্ট্রেস ও শারীরিক রোগ-বালাইয়ের প্রকাশ পায় । দীর্ঘদিন অসুখ টি থাকলে ভিন্ন ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করতে পারে । প্রাত্যহিক জীবনের কাজকর্ম জটিল করে তোলে। ম্যানিক ডিপ্রেশন হলে রোগীর মাঝে দেখা দেয় অকারণ অনুপ্রেরণা, মাত্রাতিরিক্ত সুখের দোলা। যুক্তিহীনভাবে রোগীর মাঝে দেখা দেয় কর্তৃত্বময়, অহংবোধ, বাড়াবাড়ি। মাঝে মাঝে ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপও প্রকাশ পেতে দেখা যায়। মোট কথায় খুব বেশী আবেগের ওঠানামা , মন দ্রুত বদলায়।চিন্তাভাবনা র দ্রুত পরিবর্তন থাকবেই .

  • ঋতু পরিবর্তন জাতীয় ডিপ্রেশনঃ Seasonal Affective Disorder (SAD)


কিছু কিছু রোগিরা ঠাণ্ডা আবহাওয়া এবং দিনের স্বল্পতা ও কম আলো প্রাপ্তিতে ব্যাতিক্রম ধর্মী কিছু বিষণ্ণতা দেখা দিয়ে থাকে ।

  • চিকিৎসাঃ- সত্যি যদি বেশী বিষণ্ণতা মনে হয় তা হলে মাত্র ৩ দিন , চিকিৎসকের পরামর্ষে এন্টি-ডিপ্রেশন জাতীয় ঔষধ সেবন করলে ভাল হয়ে যাবেন, তবে পুনরায় না হওয়ার জন্য লাইট থেরাপি ( শরীর কে উষ্ণ রাখার ব্যাবস্থা ) প্রতিদিন ১৫-৩০ মিনিট ৩ সপ্তাহ করে নিলে ১০০% মুক্ত হয়ে যাবেন —

  • আত্মহত্যা

আন্তন পাভলোভিচ চেখভ রুশ নাট্যকার ও ছোটগল্প-লেখক হিসেবে বিশ্ব সাহিত্যাঙ্গনে সুপরিচিত হলেও, তাঁর জন্ম (১৮৬০ সালে) কিন্তু ইউক্রেনে। চেখভ রম্য-রচনায়ও সিদ্ধহস্ত ছিলেন। তাঁর রয়স যখন মাত্র ২৬ বছর, তখন প্রকাশিত হয়েছিল ‘ÔMotley Stories’’। এটি চেখভের অনেকগুলো রম্য-রচনার একটি সংকলন। তো, এই সুসাহিত্যিক ও নাট্যকারের এক তরুণ নায়ককে জানি, যে চরম দারিদ্র্য আর প্রেমে ব্যর্থতায় কাতর হয়ে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেয়। সিদ্ধান্ত তো নেয়া হলো, এখন আত্মহত্যা করা কীভাবে? গলায় ফাঁস লাগানো থেকে শুরু করে বিষ খাওয়া পর্যন্ত, আত্মহত্যার নানান উপায় আছে।

সেগুলোর একটাও নায়কের পছন্দ হলো না। ওসব উপায় অবলম্বন করলে, মৃত্যুর পর তাঁর সুন্দর দেহটি অবধারিতভাবে মাতাল ডোমের হাতে ছিন্নভিন্ন হবে; খুবই জঘন্য একটা ব্যাপার। শেষ পর্যন্ত নায়ক ঠিক করলো, সে পানিতে ডুবে মরবে। সে-ক্ষেত্রে মৃত্যুর পর তাঁর লাশটা পুলিশের হাতে এবং আরো পরে মাতাল ডোমের হাতে পড়ার সম্ভাবনা কম। কিন্তু একটা ব্রিজ থেকে নদীর পানিতে লাফিয়ে পড়ার ঠিক আগমুহূর্তে তাঁর মনে হলো: ‘শহরের সমস্ত নর্দমা থেকে নোংরা-ময়লা নেমে আসে এ-নদীতে। ময়লার সঙ্গে থাকে অসংখ্য কীট। নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ার অর্থ, ওসব ময়লা ও কীট আমার নাক-মুখ দিয়ে ভেতরে ঢুকবে! বিভৎস!!’

চেখভের সে-নায়ক শেষমেষ আত্মহত্যার চিন্তা বাদ দিয়ে, নতুন করে বাঁচার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, যারা আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেন, তাদের খুব কমই ওই নায়কের মতো করে ভাবেন। তাই বিশ্বে প্রতিনিয়ত ঘটছে আত্মহত্যার ঘটনা। দিন দিন আত্মহত্যাকারীর সংখ্যা বাড়ছে বৈ কমছে না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (হু) হিসেবে, বিগত প্রায় পঁয়তাল্লিশ বছরে বিশ্বে আত্মহত্যার হার বেড়েছে শতকরা ষাট ভাগ। একটা সময় ছিল যখন তরুণদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা ছিল অপেক্ষাকৃত কম। কিন্তু বর্তমানে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে।

এখন তো আত্মহত্যাকারীদের বেশীরাভাগই ১৫ থেকে ২৫ বছর বয়সী তরুণ-তরুণী। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আরেকটি হিসেব মতে, সারা বিশ্বে বর্তমানে প্রতি বছর গড়ে দশ লাখ লোক আত্মহত্যা করছে। আর যারা আত্মহত্যা করবার চেষ্টা করে কোনো-না-কোনো কারণে ব্যর্থ হয়, তাদের সংখ্যা আত্মহত্যাকারীদের বিশ গুণ। আত্মহত্যার হার সবচেয়ে বেশী পূর্ব-ইউরোপের দেশগুলোতে এবং সবচেয়ে কম ল্যাটিন আমেরিকায়।

ডিপ্রেসন কি? ডিপ্রেশন কেনো আসে? ডিপ্রেশন থেকে বাঁচার উপায়!

রবীন্দ্রনাথ আকুল হয়ে বলেছিলেন:
“মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে।” অথচ এই সুন্দর ভুবন ছেড়ে চলে যেতে অনেকেই করেন না-হক তাড়াহুড়া, করেন আত্মহত্যা। কেন করেন? ইটালির কবি ও ঔপন্যাসিক সেসার পাভিস এ-প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন এভাবে: “আত্মহত্যা করবার জন্য কারুর কারণের অভাব হয় না।” তাত্ত্বিকরা এই কারণগুলোকে ব্যাখ্যা করবার চেষ্টা করেছেন নানানভাবে। তাই গড়ে উঠেছে একাধিক তত্ত্ব। মনোবৈজ্ঞানিক তত্ত্বগুলো এক্ষেত্রে জোর দিয়েছে মানুষের ব্যক্তিত্ব ও আবেগগত ফ্যাক্টরগুলোর ওপর এবং সমাজবৈজ্ঞানিক তত্ত্বগুলো বলেছে ব্যক্তির ওপর সামাজিক ও সাংস্কৃতিক চাপের কথা। আর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে যে, যারা আত্মহত্যা করেন তাদের নব্বই শতাংশই কোনো-না-কোনো মাত্রার মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত। ধারণা করা চলে যে, এই নব্বই শতাংশের একটা বড় অংশই ব্যক্তিগত ও সামাজিক চাপে পড়ে মানসিক ভারসাম্য হারায়।

কারণ যা-ই থাকুক, আত্মহত্যা কি গ্রহণযোগ্য? এ-প্রশ্নের জবাব দেবার চেষ্টা করেছেন বহু পন্ডিত ব্যক্তি। প্রাচীন যুগের প্লেটো ও এরিস্টটল এবং মধ্যযুগের অগাস্টিন ও থমাস অ্যাকিনাস থেকে শুরু করে আধুনিক যুগের লক, হিউম ও কান্টের মতো পন্ডিতরা আছেন ওই দলে। হিউম সাধারণভাবে আত্মহত্যার বিরুদ্ধে থাকলেও, বিশেষ পরিস্থিতিতে একে গ্রহণযোগ্য বলেছেন। জন লক ও ইমানুয়েল কান্ট-এর মতো দার্শনিকরা বরাবর আত্মহত্যাকে অগ্রহণযোগ্যই গণ্য করেছেন। আর প্লেটো আত্মহত্যাকে ‘কাপুরুষের কাজ’ মনে করলেও বিশ্বাস করতেন যে, বিশেষ ক্ষেত্রে একে মেনে নেয়াই উচিত। প্লেটো তাঁর Republic নামক গ্রন্থের তিন নম্বর অনুচ্ছেদে বরং প্রকারান্তরে দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত ব্যক্তিদের আত্মহত্যায় সাহায্য করতে সকলকে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করেছেন। তাঁর বক্তব্যে উদ্বুদ্ধ হয়েই কি না জানি না, বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে আজকাল ডাক্তাররা পর্যন্ত দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত (যাদের বাঁচার কোনো সম্ভাবনা নেই, অথচ তীব্র যন্ত্রণায় কাতর ) রোগীদের আত্মহত্যায় সাহায্য করছেন। যুক্তরাষ্ট্রের ওরেগন রাজ্যে ২০০২ সালে ঐরকম ৩৮ জন রোগীকে সংশিষ্ট চিকিৎসকরা প্রকারান্তরে আত্মহত্যা করতে সাহায্য করেছিলেন। ওরেগন রাজ্যে কাজটা অবশ্য বৈধ।

আধুনিক বিশ্বের বহু দেশেই আত্মহত্যার চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হয়ে ধরা পড়লে শাস্তি পেতে হয়। তবে অতীতে কোনো কোনো দেশ ও সংস্কৃতিতে আত্মহত্যা ছিল রীতিমতো গৌরবের কাজ। ভারতে এক সময় মৃত স্বামীর চিতায় সদ্য-বিধবা স্ত্রীর আত্মাহূতি দেয়া ছিল বাধ্যতামূলক এবং পূণ্যের কাজ হিসেবে বিবেচিত। প্রাচীন গ্রীসে অপরাধীদের আত্মহত্যা করার সুযোগ দেয়া হতো। জাপানে ‘হারিকিরি’ (এক ধরনের আত্মহত্যা) ছিল সৈনিকদের জন্য অত্যন্ত মর্যাদাকর। প্রাচীন ভাইকিংরা বিশ্বাস করতো যে, যুদ্ধের ময়দানে বা আত্মহত্যার মাধ্যমে মৃত্যু না-হলে স্বর্গে যাওয়া যাবে না। বৃদ্ধ হয়ে গেলে আত্মহত্যা করা ছিল প্রাচীন শিথিয়ানদের কাছে গৌরবের বিষয়। এক সময় বুদ্ধ পুরোহিত ও নানরা কোনো সামাজিক অনাচারের প্রতিবাদ জানাতে নিজেদের শরীরে আগুন লাগিয়ে আত্মহত্যা করতেন। সেসবই এখন অতীত। তবে প্রতিবাদ জানানোর ভাষা হিসেবে আত্মহত্যা এখনো ব্যবহৃত হয়। ধর্মীয় বিশ্বাস থেকেও অনেক সময় মানুষ আত্মহত্যা করে। ১৯৯৪ সালে জেনেভায় Order of the solar T নামক একটি ধর্মীয় গোষ্ঠীর ৪৮ জন সদস্য একযোগে আত্মহত্যা করেছিল। আত্মহত্যার পূর্বে তাঁরা একটি কাগজে স্বাক্ষর করে। কাগজটিতে লেখা ছিল: ‘দুঃখ নয়, বরং সুগভীর প্রেম ও আনন্দ নিয়ে আমরা পৃথিবী থেকে চলে গেলাম। তোমরা আমাদের ভাগ্যের কথা ভেবে কেঁদো না; নিজেদের জন্য কাঁদো।’
ইসলাম কিন্তু কোনো অবস্থাতেই আত্মহত্যাকে সমর্থন করে না। ইহুদী ও খ্রীষ্টান ধর্মেও আত্মহত্যা মহাপাপ। ইসলামের শেষ আসমানী গ্রন্থ আল-কুরআনের সুরা নিসায় একটি আয়াত আছে। আয়াতটি হলো: “তোমরা নিজেদের হত্যা করো না। নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের ওপর দয়ালু। আর যে বাড়াবাড়ি ও জুলুমের কাজ করবে, তাকে আমি আগুণে পোড়াবো। একাজ আল্লাহর পক্ষে সহজ।” কোনো কোনো ইসলামী পন্ডিত মনে করেন যে, আয়াতটি আত্মহত্যার বিরুদ্ধেই নাজেল হয়েছে। আর ইসলামের শেষ নবী তো আত্মহত্যাকে সরাসরিই নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন। তিনি বলেছেন:“কোনো মানুষকে অভিশাপ দেয়া তাকে হত্যা করার শামিল। কোনো মুমিনকে মিথ্যামিথ্যি কাফের বলা তাকে হত্যা করার শামিল। আর যে-ব্যক্তি কোনো জিনিষ দ্বারা নিজেকে হত্যা করবে (অর্থাৎ আত্মহত্যা করবে), কিয়ামতের দিনও তাকে সেই জিনিস দ্বারা শাস্তি দেয়া হবে।”(বুখারী শরীফ ও মুসলিম শরীফ)।

আত্মহত্যা কোনো অবস্থাতেই কাম্য হতে পারে না। আত্মহত্যার মাধ্যমে একটি জীবনই শুধু নষ্ট হয় না, প্রতিটি আত্মহত্যার বিরূপ প্রভাব পড়ে পরিবারের ওপর, আত্মহত্যাকারীর বন্ধু-বান্ধবদের ওপর। আমি দেখেছি, একটি মাত্র আত্মহত্যার ঘটনা কীভাবে একটি পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সুখ-শান্তি কেড়ে নেয়। প্রশ্ন হচ্ছে: আত্মহত্যার হার কমিয়ে আনার উপায় কী? আমাদের দেশে দারিদ্র্য দূর করা গেলে এবং নারী নির্যাতন বন্ধ করা গেলে যে আত্মহত্যার হার নাটকীয়ভাবে কমে যাবে, তা বলা-ই বাহুল্য। 

 আজকাল, সংখ্যায় কম হলেও, কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে আত্মহত্যা করবার প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। শিশু সন্তানকে বিষপানে বা আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করার পর মা নিজে আত্মহত্যা করেছেন–এমন ঘটনা সম্প্রতি রাজধানীতে ঘটেছে পরপর দুটি। পরিবারের সদস্যরা সতর্ক থাকলে এ-ধরনের দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব। এক গবেষণায় দেখা গেছে যে, আত্মহত্যাকারীদের দুই-তৃতীয়াংশই নিজেদের ইচ্ছা সম্পর্কে পূর্বেই অন্যের কাছে (যেমন: বন্ধু-বান্ধবদের কাছে) কম-বেশী তথ্য দেয়। ওসব তথ্যকে গুরুত্ব দিয়ে, যথাযথ কাউন্সেলিং-এর মাধ্যমে অনেক ক্ষেত্রে দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। উন্নত বিশ্বে সম্ভাব্য আত্মহত্যাকারীকে কাউন্সেলিং-এর মাধ্যমে আত্মহত্যা করা থেকে বিরত রাখতে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান কাজ করে (ইন্টারনেটে এমন বহু ওয়েভ-পেজ পাওয়া যায় যেগুলোতে সম্ভাব্য আত্মহত্যাকারীদের আত্মহত্যা না-করতে উদ্বুদ্ধ করে বিভিন্ন মেসেজ বা বার্তা পরিবেশন করা হয় নিয়মিত)। বাংলাদেশে তেমন কোনো প্রতিষ্ঠান কাজ করছে কি না আমার জানা নেই।

মার্কিন লেখক এডওয়ার্ড ডালবার্গ বলেছেন: “যখন কেউ উপলব্ধি করে যে, তাঁর জীবনের কোনো মূল্য নেই, তখন সে আত্মহত্যা করে নতুবা ভ্রমণে বেড়িয়ে পড়ে।” প্রথম কথা হচ্ছে, কোনো মানুষের জীবনই মূল্যহীন বা অর্থহীন হতে পারে না। তথাপি কেউ যদি তা মনে করেন-ই, আমি চাইব, আত্মহত্যার পরিবর্তে তিনি ভ্রমণকেই বেছে নেবেন। কে জানে, হয়তো ঘুরতে ঘুরতেই তিনি খুঁজে পাবেন জীবনের অর্থ! আত্মহত্যা করার সুযোগ তখন আর থাকে না।

  • ডিপ্রেশন: যে অসুখ রয়েছে মনের গভীরে

দার্শনিক ফ্রেডরিক নীৎশের এই বিখ্যাত উদ্ধৃতিটি আমি মাঝে মাঝেই নানা জায়গায় পড়ি আর ভাবি, কথাটা কি আসলেই সত্যি? সত্যিই কি আঘাত আমাদের এতোটা শক্ত করে তোলে? অনেক ভেবে উত্তর পেয়েছি- হয়তো তোলে। তবে কিছু আঘাত আছে, যা আমাদের শক্ত করে তোলে না- বরং এতোটাই বিধ্বস্ত করে দেয় যে, মরে যাওয়াটাকে অনেক কাঙ্ক্ষিত মনে হয়। ডিপ্রেশন বা বিষণ্নতা এমনই এক আঘাত।

আশ্চর্যজনকভাবে ইংরেজি এবং বাংলা দুই ভাষাতেই ডিপ্রেশন কিংবা বিষণ্ণতা শব্দটি প্রায়ই তার প্রকৃত অর্থ বোঝাতে পারে না। পরীক্ষায় খারাপ করলে, বাবা-মা’র মৃত্যুতে কিংবা অন্য কোনো কষ্টে তীব্র আঘাত পেয়ে আমরা বলি যে, আমরা বিষণ্ণ, ডিপ্রেসড। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, আমাদের শুধুই মন খারাপ। এই তীব্র মন খারাপ কিংবা ইংরেজিতে যাকে বলা যায়, Sadness , আর বিষণ্ণতা কোনোভাবেই এক না। মন খারাপ আমাদের জীবনের অংশ- স্বাভাবিকভাবেই সময়ের সাথে তা দূর হয়ে যায়। কিন্তু ডিপ্রেশন যায় না।

আমি অনেকদিন আগে টেড ডট কমে ডিপ্রেসড এক কিশোরের বক্তৃতা শুনেছিলাম- যেখানে সে বলেছিলো, “ডিপ্রেশন এমন এক রুমমেট, যাকে আপনি লাথি দিয়ে বাসা থেকে বের করে দিতে পারবেন না”। ডিপ্রেশন আর ব্যক্তিত্ব (personality) এতো গভীরভাবে জড়িয়ে থাকে যে, দুটোকে আলাদা করাটা প্রায় অসম্ভব এক ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। বিষণ্ণতা শব্দটার মাধ্যমে কোনোভাবেই আমি এই মানসিক অবস্থাটাকে অনুভব করতে পারি না। তাই পুরো লেখাজুড়েই আমি বিষণ্নতার বদলে তার ইংরেজি প্রতিশব্দ ডিপ্রেশন ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।

  •  ডিপ্রেশন সম্পর্কে আমরা কী ভাবি?

এই লেখার ভাবনাটা শুরু হয়েছিলো মূলত এই বিন্দুকে কেন্দ্র করেই। বেশ কয়েক বছর আগে ফেসবুকে একটি আলোচনা চোখে পড়ে যেখানে ভার্চুয়াল স্পেসের মোটামুটি পরিচিত এক নামকে আমি খুব রূঢ় মন্তব্য করতে দেখি, যারা আত্মহত্যা করেন তাদের সম্পর্কে। এমন মন্তব্য নতুন কিছু না, কিন্তু সেই আলোচনা পড়ে আমি আবিষ্কার করি যে, আপাতদৃষ্টিতে অত্যন্ত বিজ্ঞানমনস্ক একজন মানুষও ডিপ্রেশন সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ থেকে তার মতামত চাপিয়ে দিতে পারেন। সেই মুহূর্তে প্রথম মনে হয়, ডিপ্রেশন সম্পর্কে এই সামাজিক তাচ্ছিল্য (Stigma) দূর করা প্রয়োজন।

ডিপ্রেশন এবং আত্মহত্যা সংক্রান্ত যেকোনো আলোচনায় সবচে বেশি স্টেরিওটাইপড মন্তব্য হচ্ছে, “অমুক মানুষের জীবনে কতো কষ্ট, তবু সে সংগ্রাম করে যাচ্ছে। সে তুলনায় এই লোকের জীবন কত আরামের, তবু কেন সে এমন সিদ্ধান্ত নিলো?” কিংবা “আত্মহত্যা এক ধরনের কাপুরুষতা”। অনেকে আড়েঠারে জানান যে, “ডিপ্রেশন এক ধরনের শৌখিনতা। কই কোনো রিকশাওয়ালার তো ডিপ্রেশন হয় না” কিংবা “যে আত্মহত্যা করতে চায়, তার মরাই উচিত। এদের ব্যাপারে কোনো সিম্প্যাথি নাই”- এমন আরো বহু কথা। একটু ভালো করলে ভাবলেই বোঝা যাবে যে, প্রতিটা কথাই আসলে অজ্ঞতাপ্রসূত, এক ধরনের জাজমেন্টাল বক্তব্য। আমরা সবকিছুই বিচার করার চেষ্টা করি আমাদের অভিজ্ঞতার আলোতে। যা কিছু আমাদের অভিজ্ঞতার বাইরে, তার ব্যাপারে রূঢ় জাজমেন্ট দিতে আমাদের দেরি হয় না। অন্যের জুতোয় পা না গলিয়েই আমরা তার ব্যাপারে চটজলদি সিদ্ধান্তে চলে আসি। 

প্রতিটা মানুষের সংগ্রামই তার নিজস্ব, এবং তার ইউনিক। শুধু খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকার স্ট্রাগলই একমাত্র স্ট্রাগল না। একজন মানুষ প্রাচুর্যে বেঁচে আছে, তার অর্থ কখনোই এই না যে সে সুখে আছে, ভালো আছে। হয়তো তার পরিবার কিংবা কোনো ব্যক্তিগত সম্পর্ক তাকে অসুখী করে তুলেছে। কিংবা সবকিছু ঠিক থাকার পরও শুধুমাত্র মস্তিষ্কের রাসায়নিক সামঞ্জস্যের অভাবে সে অসুখী। কারণ যাই হোক, একজন মানুষ ডিপ্রেসড হতে পারে, এবং তার কষ্টটুকু পুরোপুরি সত্যি। আপনার-আমার যতোই মেকি মনে হোক, তাতে তার কষ্টের তীব্রতাটুকু কমে না। আরেকটা স্টেরিওটাইপড চিন্তা- গরিব মানুষ কখনো ডিপ্রেশনে ভুগে না। শুধু কষ্ট করে একটু ইন্টারনেটে খুঁজলেই এই দাবির অসারতা পাওয়া যাবে। যাদের বড় কোনো শারীরিক সমস্যাতেই ডাক্তার দেখানোর সামর্থ্য থাকে না, তারা ডিপ্রেশনকে চিকিৎসা দরকার এমন সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে ডাক্তারের কাছে যাবে, এমনটা আশা করা কিছুটা অবাস্তব। তাই ডাক্তারের চেম্বারে দরিদ্র ডিপ্রেশনের রোগী কম দেখা যাওয়াকে কোনোভাবেই “ডিপ্রেশন শুধু বড়লোকের শৌখিনতা” হিসেবে অনুবাদ করার সুযোগ নেই।

যারা গুরুতর মানসিক রোগে ভুগছেন, এবং তার লক্ষণগুলিকে আমরা সাধারণভাবে চিনতে সক্ষম, তাদের ক্ষেত্রে আমরা অনেকেই সহানুভূতিশীল হলেও, ডিপ্রেশনের ব্যাপারে আমরা বেশ নির্দয়। আমরা অধিকাংশ মানুষই একে একটা মানসিক রোগ হিসেবে বুঝতে শিখি না। দেশে থাকাকালীন সময়ে এক বন্ধুর সঙ্গে একজন মনরোগ বিশেষজ্ঞের চেম্বারে গিয়েছিলাম দুইবার। যিনি গিয়েছিলেন তিনি নিজেও ডিপ্রেশনে ভুগছেন। সেই চেম্বারে ঢুকে আমার অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হয়েছিলো। সে এক ভিন্ন পৃথিবী। আপাতদৃষ্টিতে যাদের দেখলে স্বাভাবিক, সফল জীবনের অধিকারী মনে হবে, এমন বহু মানুষের ভিড় সেই চেম্বারে। আমি উপলব্ধি করেছিলাম ডিপ্রেশন এমন এক গোপন, গভীর অসুখ, যা আমরা অনেকেই সবার অলক্ষ্যে বয়ে চলি। এমনকি হয়তো পরিবারের মানুষেরা পর্যন্ত জানে না যে তাদেরই একজন কী কষ্টের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন।

আমাদের সমাজ ক্যান্সারের মতো প্রাণঘাতী রোগে আপনার পাশে সহানুভূতির হাত বাড়াবে, অথচ ডিপ্রেশনের কথা শুনলে, যা কিনা ক্যান্সার কিংবা হৃদরোগের মতোই প্রাণঘাতী, এবং প্রতিবছর বহু মানুষের মৃত্যুর কারণ, আপনাকে ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখা শুরু করবে। একজন ডিপ্রেসড মানুষের যুদ্ধটা তাই শুধু রোগের সঙ্গেই নয়, তার চারপাশের সঙ্গেও। মূলত সেই ডাক্তারের চেম্বার থেকে ফিরে আসবার পরই আমি ডিপ্রেশন সম্পর্কে জানতে আগ্রহী হয়ে উঠি, এবং আবিষ্কার করি, আমাদের চারপাশে বহু মানুষ, যাদের আমরা “মেন্টাল”, “আধা পাগল”, “অসামাজিক”, “অলস”, “বেকুব” ইত্যাদি বলে ক্লাসিফাই করে এসেছি, তারা হয়তো শুধুই ডিপ্রেশনের স্বীকার। গোটা বিশ্বেই ডিপ্রেশন সম্পর্কে মানুষের লুকোছাপার প্রবণতা আছে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল, এবং রক্ষনশীল দেশে সেই প্রবণতা, ট্যাবু আরো বহুগুণে শক্তিশালী। এ কারণে আমাদের সমাজে একজন ডিপ্রেসড মানুষের স্ট্রাগলটাও তুলনামূলকভাবে তীব্র।

  • তবে আমাদের কেমন ব্যবহার করা উচিত? 


এর উত্তর এক কথায় হচ্ছে, সমানুভূতিশীল বা ইংরেজিতে যাকে বলে এমপ্যাথেটিক (empathetic)। সমানুভূতি শব্দটা অনেকটাই অচেনা। আমরা চারপাশে খুব একটা ব্যবহার হতে দেখি না, এর কারণ হয়তো আমাদের আচরণের মধ্যে এই গুণের অভাব। সমানুভূতি হচ্ছে অনেকটা অন্যের জায়গায় নিজেকে কল্পনা করে তার দুঃখ অনুভব করার মতো। সমানুভূতি আর সহানুভূতির মধ্যে বিস্তর ফারাক আছে। সহানুভূতির মধ্যে কিছুটা করুণার আভাস থাকে, পক্ষান্তরে সমানুভুতি জাজমেন্টশূন্য এক অবস্থান, যেখানে আপনি প্রকৃত অর্থেই অন্যের মানসিক অবস্থার একটা অনুমান পাবেন। সমানুভূতি বা এম্প্যাথি সম্পর্কে বিস্তারিত পড়তে পারেন এখান থেকে।

সহজভাবে বললে, একজন ডিপ্রেসড মানুষকে দুম করে জাজ করে ফেলবেন না। তাকে বোঝাতে যাবেন না কেন তার জীবন আরো অনেকের চেয়ে ভালো, কিংবা তার এই ধরনের চিন্তার কোনো মানে নেই। আপনি যদি ভালো মনেও কথাগুলি বলে থাকেন, তবুও আপনি আসলে তার উপকার করছেন না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ডিপ্রেসড একজন মানুষ মূলত একজন মানুষকে চায় যার কাছে সে তার কথাগুলি বলে কিছুটা নির্ভার হতে পারে, এবং অবশ্যই যে মানুষটি জাজমেন্টাল না। আপনি একজন ক্যান্সার রোগীকে কি কখনো বলবেন যে, অন্য কারো জীবন কতো ভালো, কিংবা অন্য কেউ কষ্টে থেকেও কীভাবে মানিয়ে নিচ্ছে? যদি না বলেন, তবে কেন একজন ডিপ্রেশনের রোগীকে আপনি এই কথাগুলি বলবেন, যেখানে ডিপ্রেশন ক্যান্সারের মতোই প্রাণঘাতী একটি অসুখ? কাজেই ডিপ্রেসড মানুষের প্রতি কোনো কথা কিংবা আচরণেই যেন জাজমেন্ট প্রকাশ না পায়, সেই ব্যাপারে লক্ষ্য রাখা জরুরি।




Mujahid

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Thanks for connect with us ❣️

নবীনতর পূর্বতন