কৃত্রিম মহাকর্ষ কি তৈরি সম্ভব?
এটির আসল উত্তর ছিল: কৃত্রিম মহাকর্ষ কি তৈরি সম্ভব?
স্টার ট্রেক সিরিজে অহরহ দেখা যায় কৃত্রিম মহাকর্ষের দেখা। কল্পবিজ্ঞানের গল্প-উপন্যাসেও এ ধরনের মহাকর্ষ বলের উপস্থিতি মেলে। আসলেই কি কৃত্রিম মহাকর্ষ বল তৈরি সম্ভব?
বিজ্ঞানীরা বলছেন সম্ভব। কেননা আইনস্টাইনের জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটি ব্যাপারটা সমর্থন করে। আইনস্টাইন দেখিয়েছিলেন, ত্বরণজনিত বল আর মহাকর্ষ বলের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। মহাবিশ্বের কোনো স্থানেই মহাকর্ষ বলের প্রভাব একেবারে শূন্য নয়। কারণ মহাবিশ্বের চারপাশে প্রচুর গ্যালাক্সি, নক্ষত্র, ব্ল্যাকহোল ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। এদের মহাকর্ষ বলের প্রভাব চারপাশে ছড়িয়ে পড়বেই, কারণ মহাকর্ষ বলের পাল্লা অসীম। তবে মহাশূন্যের বেশির ভাগ জায়গাতেই মহাকর্ষ বলের প্রভাব খুব কম। সেসব জায়গায় আমরা কৃত্রিম মহাকর্ষ তৈরি করতে পারি।
কীভাবে কৃত্রিম মহাকর্ষ কি তৈরি সম্ভব?
কোনো ত্বরণশীল বস্তুতে চড়ে। সুষমবেগে চলা কোনো মহাশূন্যযানে চড়ে বাড়তি বল অনুভব করা সম্ভব নয়। তখন সেই যানে বসে নিজেকে ওজনহীন মনে হবে। কিন্তু কোনো মহাশূন্যযান যদি ত্বরিত হয়, অর্থাৎ প্রতিমুহূর্তে তার বেগ বাড়ে, তখন মহাকাশচারী ধাক্কা বল অনুভব করবেন মহাকাশযানটি যেদিকে চলছে, সেদিকে। তখন চাইলে নভোচারী আর শূন্যে ভাসতে পারবেন না। মহাকাশযানটি যেদিকে চলছে, তার বিপরীত দিকের দেয়ালে পা রেখে দাঁড়াতে পারবেন, চাইলে চলাফেরাও করতে পারবেন। এই ব্যাপারটিকে বলে ছদ্ম মহাকর্ষ। কিন্তু মহাকাশযানের ত্বরণ কম হলে চলাফেরা করা কঠিন হবে, নিজেকে মনে হবে হালকা। কিন্তু যানটির বেগ বৃদ্ধির গতি সেকেন্ডে যদি ৯.৮১ মিটার হয়, তাহলে সেখানে যে ছদ্ম মহাকর্ষ বল তৈরি হবে, সেটা হবে পৃথিবীর মহাকর্ষের সমান। তখন মহাকাশযানের অভিমুখের বিপরীত দিকের অর্থাৎ পেছন দিকের দেয়ালে দাঁড়িয়ে একজন মানুষ পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে থাকার অনুভূতিই পাবেন। চলাফেরা করতে পারবেন স্বাচ্ছন্দ্যে। কিন্তু মহাকাশযানের ত্বরণ যদি ৯.৮১-এর চেয়ে অনেকখানি বেশি হয়, তাহলে ছদ্ম মহাকর্ষ বলের প্রভাবও অনেকখানি বেশি হবে। নভোচারী নিজেকে অনেকটাই ভারী মনে করবেন এবং সেখানে নড়াচড়া ও কাজকর্ম করা কঠিন হবে।
কথা হচ্ছে, এই ধরনের কোনো মহাকাশযান তৈরি সম্ভব কিনা? অসম্ভব নয়, তবে কঠিন। কারণ পৃথিবীর ত্বরণটা তৈরি হয় তার ঘূর্ণনের কারণে। এর রৈখিক বেগ সব সময় সমান। কিন্তু ত্বরণ শুধু বেগ বৃদ্ধির কারণেই হয় না। বেগ হলো ভেক্টর রাশি। দিক পরিবর্তন হলেও এর মান পরিবর্তন হয়। পৃথিবী যেহেতু সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘুরছে, প্রতিমুহূতে তাই এর দিক পরিবর্তন হচ্ছে। সুতরাং সুষম বেগে চলেও দিক পরিবর্তনের মাধ্যমে ত্বরণ ঠিক রাখা সম্ভব। আমাদের বর্তমান মহাশূন্যযানগুলো বেশিরভাগই মহাশূন্যে একটা নির্দিষ্ট গতিতে চলে। মাঝে মাঝে ত্বরিত হয়। কিন্তু ত্বরণ ধরে রাখার জন্য দরকার বিপুল পরিমাণ জ্বালানি। এত জ্বালানির জোগান অন্ধকার মহাশূন্যে দেবে কে?
সম্প্রতি মার্কিন ধনকুবের জেফ বোজেজ এ ধরনের একটি মহাশূন্যযান তৈরির উদ্যোগ নিয়েছেন। সেটির নাম ও’নিল সিলিন্ডার। মার্কিন পদার্থবিজ্ঞানী জেরার্ড ও’নিল এ ধরনের মহাকাশযানের প্রস্তাব দেন ১৯৭০-এর দশকে। মহাশূন্যে মানব কলোনি স্থাপনের সম্ভাব্যতা, পদ্ধতি ও প্রয়োগ নিয়ে ‘দ্য হাই ফ্রন্টিয়ার: হিউম্যান কলোনি ইন স্পেস’ নামের একটি বই প্রকাশ করেন তিনি ১৯৭৬ সালে। সেই বইয়ে লেখেন সিলিন্ডার আকৃতির এ ধরনের মহাকাশযানের কথা।
ও নেইলের সেই স্বপ্নের পথেই হাঁটছেন অ্যামাজনের প্রতিষ্ঠাতা জেফ বোজেস। এ মহাকাশযানের ত্বরণ হবে 1g, অর্থাৎ পৃথিবীর মহাকর্ষ ত্বরণের সমান। তাই এর ভেতরেই বসবাসকারীরা নিত্যদিনের কাজকর্ম করতে পারবেন পৃথিবীর মতোই স্বাচ্ছন্দ্য নিয়ে। এটির আকারই এমন, প্রতিনিয়ত ঘুরতে থাকবে। তাই সোজাসুজি না ছুটেও এর ত্বরণ সবসময় পৃথিবীর মহাকর্ষীয় ত্বরণের সমান রাখা সম্ভব হবে।
এতে পরস্পরের বিপরীতে ঘূর্ণায়মান দুটি সিলিন্ডার থাকবে। প্রতিটি সিলিন্ডারের দৈর্ঘ্য হবে ৩২ কিলোমিটার দীর্ঘ এবং ব্যাস হবে ছয় কিলোমিটার। দুটি সিলিন্ডার একটি বেয়ারিং ব্যবস্থার সাহায্যে পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত থাকবে। একটি রড দ্বারা যুক্ত থাকবে। এদের এই ঘূর্ণনের কারণে তৈরি হবে কৃত্রিম মহাকর্ষ বল। জেফ বোজেসের এই পরিকল্পনায় সিলিন্ডারের ভেতরটা নিছক ল্যাবরেটরির মতো হবে। মাটি, গাছপালা, এমনকি সূর্যের আলোর ব্যবস্থা থাকবে। সময়-ই বলে দেবে জেফ বোজেসের স্বপ্ন সত্যি হবে কিনা। তবে পৃথিবী ছেড়ে দূর মহাকাশে বসবাসের স্বপ্ন দেখছেন কেউ কেউ, সেটাই বা মন্দ কী?
Tags
ICT Information